GuidePedia

0
    আমে র ই৷৷৷৷৷     গণ্ডগ্রাম ( আমিশ ভিলেজ )
 
আ মি  শ সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়ে আমার কৌতূহল অনেক দিনের । টিভি , ইউটিউবে আমিশদের নিয়ে বেশ কিছু প্রোগ্রাম দেখেছি এবং তাঁদের জীবনধারা দেখে অবাক হয়েছি । একবিংশ শতাব্দীর এই যুগেও মানুষগুলো গাড়ি চালায় না , তাঁদের বাসাবাড়িতে কোন বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই , তারা প্লেনে চড়ে না নিজেদের ব্যবহার্য তেল , সাবান , শ্যাম্পু থকে শুরু করে কাপড়চোপড় সবই নিজেরাই তৈরি করে । প্রায় তিনশো বছর আগে এঁরা পেন্সিল্‌ভেনিয়ার বসতি গাঁড়ে । তিনশো বছর কম দিন নয় এতদিনে এই পৃথিবী অনেকখানি বদলেছে , মানুষ চাঁদে গিয়েছে আর বছর দশেকের মধ্যে হয়তোবা মঙ্গল গ্রহে যাবে কিন্তু আজ পর্যন্ত আমিশ মানুষের জীবনযাত্রায় তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি । সময় যেন এখানে থেমে গেছে !

মূলত এসব দেখার উদ্দেশ্যেই ২০১৮ সালের সামারের এক শনিবার সকাল নয়টায় দলবল নিয়ে পেন্সিল্‌ভেনিয়ার পথে রওনা হলাম । গন্তব্য ল্যাংকাস্টার কাউন্টি। শনিবার ভোর বিধায় রাস্তাঘাটে ট্রাফিক কম । সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগলো ঝাড়া তিন ঘণ্টা । দূরত্ব প্রায় দুশো মাইলের কাছাকাছি । আনন্দের বিষয় আমাকে গাড়ি চালাতে হয়নি । শ্যালিকার জামাই পুরো রাস্তা গাড়ি চালিয়েছে যদিও আমি ভদ্রতার খাতিরে দুই একবার বলেছি , " ভাই তোমার ক্লান্ত লাগলে স্টিয়ারিং আমার হাতে দিতে পারো ! " 

সে দেয়নি  আর আমিও সাধাসাধি করিনি ! আমার ইচ্ছাও ছিল না !  

ল্যাংকাস্টার নামের ছোট্ট শহরটি বেশ ছিমছাম চারদিকে ভালমতো চোখ বুলালে বুঝা যায় এখানকার মানুষের জীবন জীবিকা কৃষি নির্ভর । মাইলের পর মাইল ভুট্টার ক্ষেত , টোব্যাকোর ক্ষেত । ল্যাংকাস্টার কাউন্টি বেশ বড় আকারের একটি আমিশ বাজার আছে । আমাদের সবার উদ্দেশ্য বাজার ঘুরে দেখা । পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে ঢুকলাম বাজারে  । পুরো বাজার জুড়ে  ছোট ছোট সব দোকানপাট । সেখানে স্যুভেনিরের দোকান আছে , আমিশদের বেকারি , মাংসের দোকান সবই আছে । আমিশ মহিলারা বেকিংয়ে বেশ পারদর্শী । তাঁদের  বানানো কেক , পেস্ট্রি কেনা হল , খাওয়া হল যদিও ডায়াবেটিসের কারণে আমি  হতাশ চোখে সবার খাওয়া দেখলাম নিজে কিছুই খেলাম না । বাজারে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক হাঁটছি হঠাৎ করেই একটি জেলির দোকান চোখে পড়ল । নানান পদের জেলি থরে থরে সাজানো । একেকটা বৈয়মের দাম পাঁচ ডলার পঞ্চাশ সেন্ট । আমি স্ট্রবেরি আর এপ্রিকট ফ্লেভারের দুটো জেলি কিনলাম । 

আমিশ দোকানদার বলল , তুমি যদি তিনটি জেলি নাও তাহলে ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা আছে । তৃতীয় জেলির জন্য তোমাকে দিতে হবে মাত্র তিন ডলার । আমি আরেক বৈয়ম জেলি কিনলাম । সেই জেলি আবার হালাপিনো মরিচের তৈরি । খেতে ঝাল ঝাল । একসময় আমিশ বাজার দেখা শেষ হল । আমাদের বর্তমান গন্তব্য গাইডেড আমিশ কান্ট্রি ট্যুর । বাসে চড়ে চড়ে পুরো আমিশ কান্ট্রি ঘুরে দেখা । বাসের ড্রাইভার কাম ট্যুর গাইড মধ্যবয়সী আমেরিকান মহিলা । তিনি বাস চালাবেন তাঁর সাথে চলবে ধারাভাষ্য । সবাই বাসে চেপে বসলাম । গাড়ি চলতে শুরু করলো । চিকন সরু রাস্তা । দুটো গাড়ি পার হতে পারে এমন প্রস্ত । বাসের ড্রাইভার মাইক্রোফোনে আমিশদের সম্পর্কে নানান তথ্য দিচ্ছেন । যেমন ঃ 

১ঃ আমিশ মানুষদের পড়াশুনা এইট গ্রেড পর্যন্ত । তারা এর বেশি পড়াশুনা করে না । তাঁদের নিজস্ব স্কুল আছে সরকারী স্কুলে তারা যায় না । স্কুলে যে শিক্ষক তাঁদের পড়ান তাঁর নিজের পড়াশুনাও  এইট গ্রেড পর্যন্ত । আমিষ স্কুলে একটি মাত্র শ্রেণীকক্ষ থাকে । প্রথম গ্রেড থেকে এইট গ্রেড পর্যন্ত সবাই একই ক্লাসে বসে । চৌদ্দ , পনেরো বছর বয়সে তাঁদের ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটে । বিশ একুশ বছর বয়স পর্যন্ত এঁরা পরিবারের লোকজনকে ক্ষেত কৃষিতে সাহায্য করে এবং একুশ বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করে । আমিশ সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না বললেই চলে ।  

২ঃ আমিশদের যৌথ পরিবার । তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বিরোধী । প্রতিটি আমিশ পরিবারে সন্তান সন্ততি অনেক । গড়ে পাঁচ সাতজন । তারা মনে করে অধিক সন্তান ঈশ্বরের আশীর্বাদ। জীবনযাপনে তাদের কাছে পরিবার ও খেতখামার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরপরেই আছে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে নিজস্ব উপাসনালয়। তবে রোববারটা তারা রাখে গির্জার জন্য। রোববারে কেউ দোকান খোলে না, খেতেও যায় না।

৩ঃ আমিশ পুরুষের বেশিরভাগই চাষি । তাঁদের উৎপাদিত শস্য ভুট্টা , সয়াবিন ও টোব্যাকো । যারা চাষাবাদ করে না তারা আসবাবপত্র বানায় । অতি টেকসই সেসব আসবাবপত্র একশো দুশো বছর বংশপরম্পরায় ব্যাবহার করা যায় ।

৪ঃ ল্যাংকাস্টার কাউন্টিতে প্রতিটি আমিশ বাড়ি চেনার সহজ উপায় হচ্ছে সবুজ রঙের জানালার পর্দা । অন্য কোন রঙের পর্দা আমিশরা ব্যাবহার করে না । কেন কে জানে ?

৫ঃ আমিশদের যাতায়াতের বাহন ঘোড়ার গাড়ি । প্রতিটা বাড়ির সামনে একটা করে ঘোড়ার গাড়ি যা ছাই রঙের । এক একটির মূল্য চার থেকে পাঁচ হাজার ডলার ।আমিশরা নিজেদের মানুষজনের সাথে থাকতে পছন্দ করে দূরে কোথাও বেড়াতে যায় না । লাখো লাখো আমিশ মানুষ আছে যারা জীবনে কখনও ল্যানকাস্টার কাউন্টির বাইরে বের হয়নি !

৬ঃ আমিশদের নিজস্ব ভাষার নাম পেনসিলভেনিয়ান ডাচ । যা একটি জার্মান ডাইলেক্ট । নিজেদের মধ্যে তারা ওই ভাষাতেই কথা বলে তবে তারা ইংরেজি ভাষায়ও কথা বলে ।  

৭ঃ আমিশরা সরকারী কোন সাহায্য (ফুডষ্ট্যাম্প , ফ্রি মেডিক্যাল ) এসবের কোন সুযোগ নেয় না ।  এটা তাদের ধর্মীয় চেতনা-বিরোধী। বিস্ময়কর ব্যাপার হল আমিশদের কোন মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্স নেই । প্রতিটি পরিবার বছরে দুইবার চার্চে ডনেশন দেয় । চার্চ সেই টাকা নিজেদের ফান্ডে রাখে । কমিউনিটির কেউ অসুস্থ হলে সেই টাকা থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় । চিকিৎসার জন্য যদি কোন রোগীকে প্লেনে চড়তে হয় তখন চার্চের পাদ্রী বিশেষ বিবেচনায় অনুমতি দেন ।   

৮ঃ যেসব আমিশ পুরুষের দাড়ি আছে তারা বিবাহিত ।

৯ঃ আমিশরা রেডিও , মোবাইল ফোন , ইন্টারনেট , টিভি কিছুই ব্যাবহার করে না শুধুমাত্র যারা ব্যবসায়ী তাঁদের বাড়িতে টেলিফোন আছে তবে সেটা মূল বাড়ির বাইরে ।  

১০ঃ আমিশরা নিজেদের গোত্রের বাইরের মানুষকে ইংলিশ ম্যান বলে সম্বোধন করে অতএব একদিনের জন্য আমরাও হয়ে গিয়েছিলাম ইংলিশ ম্যান !!     

১১ঃ আমিশদের ব্যাবহৃত বাইসাইকেল সাদৃশ্য স্কুটারে কোন প্যাডেল নেই ।

কারা এই আমিশ ?

সুইজারল্যান্ডের জেকব আম্মান ছিলেন ভিন্ন মতবাদের খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ও একজন মন্ত্রীও। ১৬৯৩ সালে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে তাঁর ভাষায় ‘প্রকৃত বাইবেলীয়’ জীবনধারার একটা মতামত প্রকাশ করেন তিনি। এই মতের সঙ্গে মিলে যারা তাঁর অনুসারী, পরে তারাই পরিচিত হলো আমিশ নামে। তাদের কিছু লোক ছড়িয়ে পড়ল আমেরিকা, কানাডা ও ব্রিটেনে। গত দুই শ বছরে তাদের সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি। আমেরিকায় পেনসিলভানিয়ার মাধ্যমে শুরু হয় আমিশদের অভিবাসন। পরে ওহাইও, ইন্ডিয়ানা, উইসকনসিন, নিউইয়র্ক, মিশিগান, মিজৌরি, কেনটাকি—এসব রাজ্যেও বসবাস শুরু করে তারা। ১৯২০ সালের জনমত জরিপে পুরো আমেরিকায় তাদের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের মতো। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখে। ১৯৫০ সালের পর নিজেদের উত্তর পুরুষ ছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মের মাত্র ৭৫ জন যুক্ত হয়েছে আমিশ জীবনধারায়। তবে এখানেও আছে বিভাজন। গোটা আমেরিকায় ২৫ রকম আচারিক গির্জা আছে তাদের। নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত তারা। প্রতিটি গোত্রের আছে নিজস্ব কিছু সংস্কার ও বিধিমালা। এর বাইরে কেউ যায় না।
সময়টা দুপুর। মাথার উপর গনগনে সূর্য ,অসহনীয় তাপমাত্রা তবে আকাশটা পরিষ্কার একফোঁটা মেঘের কোন আলামত নেই ! আমেরিকার অজ-পাড়া গাঁয়ের এক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি । আমাদের ভাড়া করা ট্যুর বাসটি সবাইকে এক আমিশ ফার্মের সামনে নামিয়ে দিয়েছে। নামার সময় মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ মহিলা ড্রাইভার বলল , তোমাদের হাতে বিশ মিনিট সময় আছে যা দেখার দেখে নাও তবে আমিশদের বানানো প্রেটজেলস খেতে ভুলবে না আর তাঁদের কোন ছবি তুলবে না ।
আমরা সায় জানিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। নামার পর বিস্মিত চোখে চারপাশটা দেখছি আর মনে মনে বলছি , “ এ কোথায় এলাম ” ? চারদিকে ভুট্টার ক্ষেত।  প্রতিটা গাছের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট ! শস্য দেখে মনে হল আমেরিকার অগ্রাহায়ন মাস চলছে । আমাদের দেশের সোনালি ধানের ফসলের মতন সোনালি ভুট্টার ফসল । আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম।  অনেকক্ষণ সিগাটের টানা হয়নি। ফুসফুস নিকোটিনের জন্য হাহাকার করছে । আমি সিগারেট ধরিয়ে মহানন্দে টানছি আর চারপাশটা দেখছি । গরুর গোবর বিকট গন্ধ  , পাকা শস্যের ঘ্রাণ নাকে লাগছে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের কোন গ্রামে এসে পড়েছি । বিচিত্র শোনালেও সত্য এই গন্ধ আমার ভাল লাগছে । গ্রাম তো এমনই হবে । যাইহোক । এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি ঠিক তখনই  লক্ষ্য করলাম আমার সামনের জমিতে এক আমিশ কৃষক তিনটে ঘোড়া আর লাঙ্গল নিয়ে হাল বাইছে । ঘোড়াগুলো অত্যন্ত বলশালী । আমি বাংলাদেশের মানুষ ,সারাটা জীবন গরু দিয়ে হাল চাষ করতে দেখেছি ঘোড়া দিয়েও যে হাল বাওয়া যায় সেটা আমার জানা ছিল না।  ঘোড়ার পেছনে যে লাঙ্গল লাগানো সেটি লোহার তৈরি । লাঙ্গলের দুপাশে দুটো চাকাও আছে। দেখে মনে হল হাই-টেক লাঙ্গল !  যে লোকটি হাল বাইছে সেও আমার মনে যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি করেছে , আমি তাঁর দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি । বিগত দুই যুগে এমন কাউকে আমেরিকায় দেখিনি কিংবা চোখে পড়েনি ।  আমার বাস নিউ ইয়র্ক নামের এক কংক্রিটের জঙ্গলে যেখানে এসব অনুপস্থিত !

লোকটির উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট , তাঁর হালের ঘোড়ার মতন সে নিজেও বলশালী ,  চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী ! লোকটির মুখ ভরতি হালকা বাদামি রঙের দাড়ি তবে গোঁফ নেই তাঁকে দেখাচ্ছে আমাদের দেশের হুজুরদের মতো । লোকটির গায়ের রং ধবধবে ফর্সা তবে তীব্র রোদের কারণে চেহারাখানা কমলা বর্ণ ধারণ করেছে তাঁর মুখটা ঘামে ভেজা , চোখগুলো ক্লান্ত , চুলের জুলফির দুপাশ দিয়ে ঘাম বেয়ে নামছে। লোকটির পরনে হালকা বেগুনি রঙের হাফ শার্ট সাথে কালো প্যান্ট । মাথায় বেত দিয়ে বানানো বিশেষ ধরণের হ্যাট । হ্যাটটি দেখতে অনেকটা টেক্সান স্টেটসন হ্যাটের মতন । লোকটির পরনের প্যান্টে কোন বেল্ট নেই কালো রঙের সাসপেন্ডর বেল্টের কাজ সারছে । সাসপেন্ডের দুই ফিতা দু কাঁধের উপর ঝুলে আছে ।   

আমি পকেট থেকে ফোন বের করলাম । উদ্দেশ্য একটা ছবি তুলবো  ঠিক তখনই ড্রাইভারের কথা মনে পড়লো আমিশ মানুষ ছবি ওঠতে পছন্দ করে না এমনকি তাঁদের বাসাবাড়িতে গেলেও কোন ছবি চোখে পড়বে না ! তাঁদের জীবনধারা আর বিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখে আমি ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম । দলের সবাই তখন প্রেটজেলস খেতে ব্যস্ত । আমি নিজেও খেলাম । এমন উপাদেয় প্রেটজেলস এর আগে কখনও খাইনি । নিউ ইয়র্কের হটডগ ভেণ্ডাররা যে প্রেটজেলস বিক্রি করে সেটা এই প্রেটজেলসের ধারে কাছেও যাবে না । 
প্রেটজেলস ফ্রেটজেলস খেয়ে আবারো গাড়িতে চড়ে বসলাম । বর্তমান গন্তব্য আমিশ ফার্ম ।

আমিশদের ফার্মগুলো বিশাল যা সাধারণত মূল বাড়ির কাছেই থাকে । সেখানে ঘোড়ার আস্তাবল আছে , গরুর ঘর আছে । সোজা বাংলায় যাকে বলে গোয়াল ঘর । এঁদের একেকটা গরুর বিশাল আকৃতির । আমি খুব আগ্রহ নিয়ে গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি । 

সহধর্মিণী আমার পাশে এসে বলল , " এতো মনোযোগ দিয়ে গরু দেখার কি আছে আমার সাথে এসো স্যুভেনির শপটা দেখে আসি " 

আমি নড়লাম না । ওঁকে বললাম , এই গরুগুলোর মাংস খেতে কি মজাদার হবে ভেবে দেখেছ ?

সে আমার দিকে আহত চোখে তাকিয়ে বলল , " খাওয়া দাওয়া ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে পারো না তুমি ? " 

আমি কিছু বললাম না । আমি কল্পনায় তখন ওই গরুর গোশতের তরকারি দেখছি , সাথে এক প্লেট ধুঁয়া ওঠা চিকন চালের ভাত !!!  আমি ভেতো বাঙালি আজ দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি !

আমিশ ফার্ম দেখা শেষ হল ওঁদের বাড়িঘর-ইবা বাদ যাবে কেন ? ষোল করা পূর্ণ হোক ! এবার আমিশ বাড়ি দেখা  আর ঘোড়ার গাড়ি চড়ার পালা । বাড়ি দেখার আগে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বসলাম । গাড়ির চালক বিরাশি বছর বয়সী আমিশ ভদ্রলোক । কথাবার্তায় অন্ত্যন্ত রসিক । আমাদের পুরো বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এগারো জন । ঘোড়ার গাড়িতে দশজনের বেশি ধরে না । আমার ভায়রা গাড়িতে উঠলো না । সে এর আগে দুবার ঘোড়ার গাড়ি চড়েছে । যাইহোক , ঘোড়ার গাড়িতে যাত্রা শুরু হল । আমি আর আমার আরেক ভায়রা বসেছি সামনের আসনে চালকের পাশে । হেলে-দুলে ঘোড়াটি আমাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । ঘোড়ার চালক বকবক করেই যাচ্ছে । এক বাড়ির সামনে থামলাম । চালক ভদ্রলোক বাড়ির দিকে হাত ইশারা করে বললেন , " ওই যে বাড়িটি দেখছ ওই বাড়িতে আজ থেকে একষট্টি বছর আগে অতি রূপবতী এক মেয়ে বাস করতো কেউ কি বলতে পারবে ওই মেয়েটি কে ? " 

আমি হেসে বললাম , " তোমার স্ত্রী " 

চালক হেসে সায় জানালো । আমিশ লোকেরা তাঁদের ঘোড়ার ভাল যত্ন নেয় । এক পর্যায়ে আমি চালককে জিগ্যেস করলাম , " আচ্ছা এই ঘোড়ার বয়স কত ?

চালক বলল , বিশ বছর । ঘোড়া সমাজে সে আমার মতনই একজন প্রৌঢ় ! বৃদ্ধ ঘোড়াটি আমাদের নিয়ে এক ব্রিজের উপর উঠলো । বুঝতে পারলাম বেচারার কষ্ট হচ্ছে । ঘোড়া যে ঘামে সেটা আমার জানা ছিল না । দেখলাম ঘোড়ার পেটের দিকটা ঘামে ভেজা । ব্রিজে ওঠার আগ মুহূর্তে আমার দুই মেয়ে এক লাফে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে পড়ল তাঁদের দেখাদেখি আমার শালিকারা । তারা বৃদ্ধ ঘোড়াটিকে কষ্ট দিতে চায় না । পুরো ব্যাপারটি ঘোড়ার চালককে বিস্মিত করেছে ।   

আমিশদের ঘরবাড়ীর সাজসজ্জা একেবারে সাদামাটা । তাঁদের শোবার ঘরের বিছানা দেখে আমার নানাবাড়ি , দাদাবাড়ির আগের আমলের পালঙ্কের কথা মনে পড়লো । দেখতেও মোটামোটি এক !

রাতে নিউ ইয়র্ক ফিরছি।  স্ত্রীকে বললাম , চলো এক কাজ করি বাড়িঘর সব বিক্রি করে আমিশদের এলাকায় একটা বাড়ি কিনে ফেলি।  

সে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , " ক্ষেতে কে কাজ করবে তুমি ? " তোমার মতন অলস লোক ? 

আমি বললাম ,  না ! এক আমিশকে জমিজমা বর্গা দিয়ে দেব সে চাষবাস করবে , বছর শেষে টাকা দেবে।  

আমার স্ত্রীর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আমার প্ল্যানটা তার পছন্দ হয়েছে !

Post a Comment

 
Top