রেডিয়াম আবিষ্কার ও ‘রেডিয়াম কন্যা’দের করুণ পরিণতি
‘রেডিয়াম’ শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘রেডিয়াস’ থেকে, যার অর্থ ‘রশ্মি’। রেডিয়াম তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮৮। পদার্থটির আবিষ্কারক মেরি কুরি ও তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি। এই মৌলিক পদার্থ আবিষ্কারের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে মানুষের প্রথম ধারণা জন্মায়।
খনি থেকে আহরিত ‘পিচব্লেন্ড’ পরীক্ষা করতে গিয়ে কুরি দম্পতি দেখেন, তার মধ্য থেকে ইউরেনিয়ামের চেয়ে চার গুণ শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় রশ্মি বের হচ্ছে। পিচব্লেন্ড থেকে পরিচিত মৌলগুলো আলাদা করার পরও তাঁরা দেখতে পান, তার মধ্যে পরিচিত মৌল ছাড়া অধিক তেজস্ক্রিয় একটি অজানা পদার্থও আছে। এই পদার্থ নিয়ে গবেষণা করার পর বুঝতে পারেন, নতুন একটি তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। ১৮৯৮ সালের ২১ ডিসেম্বর এই মৌল আবিষ্কার করেন কুরি দম্পতি। এর পাঁচ দিন পর তাঁরা ফ্রান্সের প্যারিস একাডেমি অব সায়েন্সের কাছে একটি গবেষণাপত্র পেশ করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘পিচব্লেন্ডে অবস্থিত অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন নতুন মৌল’। পরবর্তী সময়ে মৌলটির নাম দেওয়া হয় ‘রেডিয়াম’।
অন্যান্য তেজস্ক্রিয় মৌলের তুলনায় রেডিয়াম আবিষ্কার ছিল বেশ সহজ। কারণ, এর বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট এবং অন্যান্য মৌলের থেকে আলাদা। বিশুদ্ধ রেডিয়াম পেতে আরও ৪৫ মাস অপেক্ষা করতে হয় কুরি দম্পতিকে। ৮ টন পিচব্লেন্ড চূর্ণ করে এবং প্রায় ১০ হাজারবার আংশিক কেলাসন করে তাঁরা ১ ডেসিগ্রাম বিশুদ্ধ রেডিয়াম সংগ্রহ করেন।
রেডিয়াম আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানজগতে তাঁদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও তখনো তাঁদের ছিল না কোনো উন্নত গবেষণাগার। তখন পিয়েরে কুরি ছিলেন গবেষণাগারের একজন ডেমনেস্ট্রেটর আর মেরি কুরি ছিলেন হাইস্কুলের বিজ্ঞানশিক্ষক। রেডিয়াম আবিষ্কারের কোনো পেটেন্ট করেননি তাঁরা। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বিনা মূল্যে জানিয়ে দেন রেডিয়াম সংগ্রহের উপায়। রেডিয়াম ক্ষতিকর মৌল হওয়ায় কুরি দম্পতি নিজেরাও রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হন এবং তাঁরা রেডিয়ামের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করেন।
তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ হিসেবে প্রথম বাস্তব প্রয়োগ করা হয় রেডিয়ামের। আমেরিকায় রেডিয়ামের অপরীক্ষিত ব্যবহার কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারে ঘড়ি দেখার সুবিধার্থে ঘড়ির ডায়াল ও কাঁটায় রেডিয়াম ব্যবহৃত হতে থাকে। তখনকার দিনে এসব ঘড়ি আভিজাত্য ও শৌখিনতার প্রতীকে পরিণত হয়। এ ধরনের ঘড়ি প্রস্তুতকারী প্রথম কারখানা ১৯১৭ সালে নিউ জার্সির অরেঞ্জ শহরে স্থাপিত হয়। মাত্র ৭০ জন নারী শ্রমিক দিয়ে শুরু হওয়া এই কারখানায় কয়েক বছরে শ্রমিকের সংখ্যা কয়েক হাজারে উঠে যায়।
রেডিয়াম থেকে রশ্মি বিকিরিত হওয়ায় প্রথম দিকে একে একটি অলৌকিক পদার্থ ও শক্তি উৎপাদক হিসেবে মনে করা হতো। ফলে রেডিয়ামের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। বিভিন্ন খাদ্যবস্তুতে রেডিয়ামের ব্যবহার শুরু হয়। অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার জন্য রেডিয়াম–মিশ্রিত পানি পান করানো হতো। তা ছাড়া নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী যেমন টুথপেস্ট, প্রসাধনী প্রভৃতিতে রেডিয়ামের ব্যবহার শুরু হয়।
ঘড়ির ডায়াল ও কাঁটায় রেডিয়াম যোগ করার কাজটি বেশ কঠিন ছিল। তুলিতে রেডিয়াম–মিশ্রিত রং মেখে সেই তুলির মাথা বারবার ঠোঁট দিয়ে সুচালো করে নিতে হতো। এভাবে কারখানার নারী শ্রমিকদের শরীরে তাঁদের অজান্তে রেডিয়াম প্রবেশ করত। কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের আশ্বস্ত করেছিল যে রেডিয়াম সম্পূর্ণ নিরাপদ। ফলে শ্রমিকেরা ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবেও রেডিয়াম ব্যবহার করতে শুরু করেন। অনেকে চুল, চোখের পাতা, দাঁত, নখ ও ঠোঁটে রেডিয়ামের প্রলেপ লাগাতেন।
কয়েক বছর যেতে না যেতেই শ্রমিকদের শরীরে রেডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করে। অনেকের মধ্যে অবসাদ দেখা দেয়, দেহে রক্তশূন্যতা ও দাঁতে ব্যথা শুরু হয়। অনেকেরই দাঁত তুলে ফেলতে হয় বাধ্য হয়ে। কারও চোয়ালে পচন ধরতে শুরু করে। কারও শরীরে ধরা পড়ে ক্যানসার। এভাবে শুধু নিউ জার্সির কারখানাটিতেই কয়েক শ শ্রমিক মারা যান। শরীরে রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার লক্ষণ দেখা দিতে কয়েক বছর লেগে যায়। ফলে কয়েক বছরে শত শত শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
১৯২৫ সালে গ্রেস ফ্রেইয়ার নামের এক নারী শ্রমিক নিউ জার্সির ঘড়ি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কোনো আইনজীবী কারখানার প্রভাবশালী মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মামলায় লড়তে রাজি হচ্ছিলেন না। তা ছাড়া রেডিয়ামের কারণেই শ্রমিকদের মৃত্যু হচ্ছে, এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত ছিলেন না। একজন আইনজীবী খুঁজতে শ্রমিকদের আরও দুই বছর লেগে যায়। এরপর লিওনার্দো গ্রসমান নামের এক আইনজীবী বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেন। আদালতে রেডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আদালত ঘড়ি তৈরির কারখানায় অরক্ষিত অবস্থায় রেডিয়ামের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন এবং কারখানা কর্তৃপক্ষকে রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বের মানুষ রেডিয়ামের ভয়াবহতার কথা জানতে পারে, যা কুরি দম্পতি অনেক আগেই উল্লেখ করেছিলেন।
রেডিয়াম আবিষ্কারক হিসেবে মেরি কুরি ও তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরির নাম বলা হলেও এই আবিষ্কারের পেছনে মেরি কুরির অবদান ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। শুধু রেডিয়াম আবিষ্কার নয়, ক্যানসার চিকিৎসায় তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহারের পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় নারীদের অংশগ্রহণের অগ্রদূত মেরি কুরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছুটে গেছেন যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসায়। এক্স-রে ও রেডিয়াম ব্যবহার করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন শত শত মানুষের। ইউরোপের সর্বপ্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনকারী নারী তিনি। প্রথম নারী এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী হিসেবে দুইবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। স্বামী পিয়েরে কুরির মৃত্যুর পরও দুই শিশুকন্যাকে আঁকড়ে ধরে বিজ্ঞানচর্চায় এগিয়ে গেছেন সগৌরব।
Source: প্রথম আলো
Post a Comment