কম খরচে টেকসই বাড়ি করার কিছু টিপস-১
আমি বড় কোন ইঞ্জিনিয়ার নই, ছোটখাটো একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯ বছরের মতো সময় দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকেই কিছু জিনিস শেয়ার করতে চাই, যা সার্বিক মানুষের উপকার না হলেও নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কাজে আসতে পারে।
একটি বাড়ি একজন মানুষের সারাজীবনের স্বপ্ন। এক জীবনে একাধিক বাড়ি নির্মাণ আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয় বিধায় কিছুটা হিসাব নিকাশের মধ্য দিয়ে চললে খরচ কমানো সম্ভব। আপামর সাধারণের সুবিধার্থে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এর শব্দ পরিত্যাগ করে সাবলীলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বাড়ি বলতেই আমাদের চোখের সামনে বিশাল অট্টালিকা ভেসে ওঠে, এটাই সবাই চিন্তা করি, স্বপ্নও দেখি। কিন্তু আমাদের সামর্থ্য সম্পর্কে বুঝতে হবে আগে। আমি ১ মন ওজনের কিছু তুলতে পারি, সেখানে ২ মণের চাপ কেন নিতে যাবো?
২ তলা বাড়ির জন্য ২ তলার ফাউন্ডেশনই তো করা উচিৎ, তাই নয় কি? ২ তলা বাড়ির জন্য ৪ তলা ফাউন্ডেশন কেন করবেন? মাটির তলেই তো অনেক টাকা ফেলে রেখে দিবেন। আপনার সামর্থ্য আছে ২ তলা বাড়ি করার, সেটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকেন। অযথা নিজে ঋণের বোঝা টানবেন, ঘরের বউকে বলবেন “যা বাপের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আয় বাড়ির জন্য” (মশকরা করলাম)। ২ তলা বাড়ির জন্য ২ তলা ফাউন্ডেশন করলেই কিন্তু অনেক খরচ কমে যাবে।
আপনাকে জানতে হবে আপনার কত টাকা আছে বাড়িটির কাজ শেষ করার জন্য। ধরুন, আপনার পরিবারে আপনারা স্বামী স্ত্রী এবং ২ ছেলে মেয়ে নিয়ে বসবাস করবেন। সেইক্ষেত্রে আপনাদের রুম দরকার হবে ৩টি, একটি গেস্ট রুম। বাড়ি করার আগে, ডিজাইন করার আগে ঘরের সদস্যদের নিয়ে বসুন। তাদেরও একটা মতামত অবশ্যই আছে। ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়েই বাড়ির ডিজাইন করান। এই ব্যাটা কিন্তু লেখাপড়া করেছে এই কাজের জন্য। একজন মিস্ত্রি অভিজ্ঞ মানুষ, তার কাজের ক্ষেত্রে। শত শত বাড়ি করার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। কিন্তু একজন ইঞ্জিনিয়ার জানে একটা বাড়ির কলাম পিলার ফাউন্ডেশন কতটুকু চাপ নিতে পারে। ধরুন, RFL কোম্পানি একটা চেয়ার তৈরি করবে। কতটুকু মোটা বা চিকন পা বানাবে তা কিন্তু এই চেয়ারের ইঞ্জিনিয়ার জানে। এটা তাকে ১+১ = ২ যোগ করার মতো করে শিখে আসতে হয়েছে।
আপনার নিজের বাড়িতে জমিদারি স্টাইলে মিস্ত্রি হেলপারদের হুকুম করা বাদ দিন। পারলে নিজে হেলপারের সাথে কাজ করুন। প্রতিদিন একজন হেলপারের সাথে কাজ করলে বাড়ির কাজ শেষ হলে ১৫ হাজার টাকা কি বাঁচাতে পারবেন না? (গ্রাম ও মফঃস্বলের দিকেই এটা সম্ভব)।
ভালো ইট, বালি, সিমেন্ট, খোয়া, সিমেন্ট চিনতে শিখুন।
আপনাকে ইঞ্জিনিয়ার বা মিস্ত্রি হিসাব দিল যে, এই কাজে ৫০০ ফুট বালি বা খোয়া লাগবে। আপনি দোকানে গিয়ে বললেন, ৫০০ ফুট বালি পাঠিয়ে দিন। তিনি ৫০০ ফুট বালির টাকা আপনার কাছ থেকে হিসাব করে রেখে দিলেন। আপনি কি আপনার বাসায় ৫০০ ফুট বালি পাচ্ছেন? প্রতি ভ্যান বা গাড়িতে বালি কম থাকবেই। কিন্তু আপনি তাকে ৫০০ ফুট বালির টাকা দিয়েছেন। ভ্যান বা গাড়ি মাপতে শিখুন। ভ্যানের লম্বা x চওড়া x উচ্চতা গুণ করে ফেলুন। ধরুন, ভ্যানটির বালি রাখার জায়গা ৩ ফুট লম্বা, ২ ফুট চওড়া এবং বালির ভিতর কাঠি ভরে দিয়ে মেপে দেখলেন এর উচ্চতা ১.৫ ফুট বা দেড় ফুট। তাহলে বালি আছে কতটুকু? দোকানদারের সাথে চুক্তি করুন যে আমি বালি মেপে ফুট হিসাবে টাকা দেবো। সবাই যে আপনার শর্তে রাজি হবে তা নয়, তবে কাউকে না কাউকে পাবেন।
বালি কিনে নিয়ে এসে বাসার সামনে ফেলে রাখলেন। কুকুরে ঠ্যাং উচিয়ে হিসু করবে, কুকুর বিড়াল মোরগ মুরগি মারামারি করবে, বাতাসে উড়ে যাবে, পাশের বাড়ির কারো মেঝে নষ্ট হয়েছে, সে রাতের আঁধারে এক বালতি বালি নিয়ে যাবে। মেপে বালি আনার পরে তাহলে কতটুকু বালি পাচ্ছেন? এক ফুট বালির দাম ৩৫ টাকা হলে পুরো বাড়ির কাজ শেষ হলে এমন কত ৩৫ টাকা লস দিচ্ছেন? ৪/৫ হাজার?
বালি কিনে আনার পর তার উপর ইট বা পলিথিন এই টাইপের কিছু দিয়ে ঢেকে রাখুন।
খুচরা খোয়া না কিনে পিকেট কিনে খোয়া করুন। ১/২ নম্বর ইটের খোয়ার উপর কিছু কালো রঙের পোড়া ইটের খোয়া মিশিলাই কিন্তু তা পিকেট ইটের খোয়া হয়না। কিন্তু আপনি এসবের দাম কিন্তু ১ নম্বরের পরিশোধ করছেন।
রড মাটি বা মেঝের উপর রাখবেন না। অন্তত কয়েকটা ইটের উপর রাখুন।
ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে মিস্ত্রির সাথে ডিজাইন নিয়ে বসুন। লিখিত নিন যে, আপনার বা ইঞ্জিনিয়ারের আদেশ ছাড়া তিনি একটি ইটও গাথবেনা। যদি গাঁথে তাহলে ক্ষতিপূরণ দিবে।
সামর্থ্য কম? ইটের দেয়ালে প্লাস্টার করা বাদ দিন। ইটের গায়ে পয়েন্টিং করুন। নেট তো সবাই চালাই। ফেসবুক ইউটিউবের পিছনে না ঘুরে ইটের পয়েন্টিং লিখে গুগলে সার্চ দিলেই তো অনেক কিছু পাবেন। ২/৩ বছর পরপর রঙ করার খরচ বাঁচবে। পয়েন্টিং এর গাঁথুনিতে মসলা দিতে হয় সমান করে। ইট বসিয়ে দুই পাশে ৮ মিলি রড ব্যবহার করুন, মসলা এক বিন্দুও নষ্ট হবেনা। প্লাস্টারের দেয়ালের মতো এবড়োথেবড়ো করে নয়। ফলে সিমেন্ট বালিও বাঁচে। মিস্ত্রি খরচ সামান্য বেশি হলেও কাজ শেষে দেখবেন ২০%-২৫% টাকা বেঁচে গিয়েছে। দেখতেও তো ভালো লাগে।
পয়েন্টিং এর ক্ষেত্রে সাধারণ ভাটা, অটো ব্রিকস বা সিরামিকের যে ইট ব্যবহার করুন না কেন ইটের গায়ে সিমেন্ট বালি কিংবা মসলার পানি জমতে দিবেন না। পরিস্কার পানিতে ফোম ভিজিয়ে মুছে দিন। এটা নিজে করবেন। হেলপার দিয়ে এই কাজ হয়না। বাড়ির কাজ শেষ হলে পয়েন্টিংকৃত দেয়ালে ভার্নিশ এর একটা কোট বা যেকোনো তেল দিতে পারেন। অবশ্য এটা দিবেন ৫/৬ মাস পর। বছরে একবার দিলেই হবে, না দিয়েও ভালো লাগে। পয়েন্টিং এর মসলায় সিমেন্ট সামান্য একটু বেশি দিবেন।
টিনের চালের জন্য টিনের নিচে মাচান (আড়া) করতে ছবি খেয়াল করুন। এটাই মজবুত বেশি। এতে করে অনেক বাঁশ, কাঠ বাঁচবে।
টয়লেটের মধ্যে সাবান দানিটাও কিন্তু একটা ইট ঘুরিয়ে দিয়েও করা যায়। এতে কি ১৫০ টাকা বাঁচেনা?
ফ্লোরে টাইলস বানানো হয়েছে। এটাকে বলে ফেরো সিমেন্টের কাজ। ইন্টারনেট ঘাটুন। এতেও ফ্লোরের খরচ কম হয়।
১টা ইটের দাম যদি ১০ টাকা হয়, তাহলে এভাবে ১০ টাকা করে বেহুদা খরচ বাঁচাতে থাকুন। কাজ শেষে ১০/২০/৩০ হাজার এমনিতেই বাঁচাতে পারবেন।
ঘরের মধ্যে পর্যাপ্ত আলো বাতাস আসতে দিন। ১০ বছর আগের গরম আর ২০২২ সালের গরম কিন্তু এক নয়। ২০৩৫ সালের গরম কেমন হবে?
কিউরিং, অর্থ পানি দিয়ে ভিজানো। সিমেন্টের কাজ যেখানেই আছে সেখানেই কিউরিং করতে হবে। নামীদামী ইঞ্জিনিয়ার, বিখ্যাত মিস্ত্রি, নামীদামী সব ব্র্যান্ডের মালামাল ব্যবহার করুন না কেন ঢালাই বা প্লাস্টার কাজের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে আপনি কতটা সঠিকভাবে কিউরিং করছেন। প্লাস্টিকের মগে বা বদনায় করে সামান্য না ভিজিয়ে গোসল করান।
আমার কাজের অভিজ্ঞতার কিছু ছবি শেয়ার করলাম। ভালোভাবে দেখুন। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা। সাতক্ষীরাতে একটা দোতলা বাড়ি বানিয়েছিলাম ৩ বছর আগে। ১ম তলায় ছাদ, ২য় তলার উপরে রঙিন টিন (৩২ মিলি পুরু)। বাড়িটি ১৬x২৪ ফুটের ছিল। খুব ছোট একটা জায়গা। ৩টা বেড, ডাইনিং, কিচেন, টয়লেট ইত্যাদি। খরচ হয়েছিল ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা! ১টি টাকাও ফাও খরচ হতে দেইনি। তদারকি বড় একটা ফ্যাক্টর। ঠিকাদারকে দিয়ে বাড়ি করালেও আপনাকে আপনার বাড়ির কোয়ালিটি দেখতে হবে।
আসলে বাড়ি নির্মাণ মানেই টেকনিক্যাল ব্যাপার স্যাপার। এভাবে কতটা বোঝানো যায় বুঝতে পারছিনা। ২ বছরে এই ধরণের প্রায় ৩০টি বাড়ি তৈরি করেছিলাম, সেই আলোকেই শেয়ার করেছি।।
ভাই, আমার এতোটুকু জায়গা আছে। আমি একটা বাড়ি করতে চাই দোতলা ফাউন্ডেশনের, কত খরচ হতে পারে? প্লিজ এই ধরণের প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিন। ৪ হাজার টাকার মোবাইলেও ক্যামেরা থাকে, দেড় লক্ষ টাকার মোবাইলেও ক্যামেরা থাকে। স্থান, পরিবেশ, পাত্র কাল, জমির ধরণ, আপনার চাহিদা, আপনার বাজেট ইত্যাদির উপর খরচ নির্ভর করে। এটা ফেসবুকের একটা কমেন্টসের উত্তরে হয়না।
আমি সচরাচর ভিন্ন কিছু করতে ভালবাসি। এদেশের মিউজিককেও ভালবাসি। মিউজিক নিয়ে কাজও করি। আমার সংগ্রহে এদেশেরই প্রায় ৬০০০ অডিও ক্যাসেট ও সিডি আছে। ১০ জন মহিলা একই রঙের শাড়ি পরে যখন কোথাও যাবে, তখন সেখান থেকে আলাদা করে কাউকে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু এই ১০ জনের ভিতর যদি কেউ একজন ভিন্ন কিছু পরিধান করে থাকে, তখনই সবার নজরে আসবে।
আমাকেও প্রচুর শিখতে হয়েছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলেও এদিক সেদিক তাকিয়েছি নতুন কিছু আবিষ্কারের আশায়। সাথের ২/১ জন কলিগ এবং মাথার উপর ছাদ হয়ে থাকা ২/১ জন শিক্ষকের জন্যই এগুলো করতে পেরেছি। এগুলো দেখতে যখন আফ্রিকা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড থেকে বিভিন্ন এনজি'র লোক এসেছেন, তাদেরকে যখন দেখাতে পেরেছিলাম, বাহবা পেয়েছিলাম, তখন নিজের জন্য নয় "আমরাও পারি" বলে খুব গর্ব হতো। মনের সন্তুষ্টির জন্যই এই কাজগুলি। এটা প্রতিনিয়ত শিখতে হয়।
[আশিক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, খুলনা]
আজ এটুকুই। (পরের পর্ব পরে, আরো ছবিসহ)
Post a Comment