চুই ঝাল - খুলনা জেলার জনপ্রিয় পণ্য
নামটি ঝাল হলেও মোটেও ঝালের মতো দেখতে না, তবে খেতে আসলেই ঝাল আর দারুণ একটা ফ্লেভার আছে। ঝাল প্রেমীদের ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে
চুই ঝাল কি?
এটা লতা জাতীয় উদ্ভিদ। প্রাকৃতিকভাবে সাধারণত পরগাছা এটি। খুলনা জেলার মানুষ গরুর মাংস এবং খাসির মাংস রান্নায় এটা স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করে। দেখতে কাঠের মত। যারা এটা চেনেন না তারা মাংসের মধ্যে দেখে অবাক হতে পারেন। মাংসে আলাদা একটা সুঘ্রাণ বের হয় আর স্বাদ করে তোলে অতুলনীয়।
আম, জাম, জিওল, সজনে গাছে এটা ভালো হয়। এখন চুইঝালের উপকারিতা জানার পর এর পাতাও অনেক শাকের সাথে বা তরকারির সাথে খায়। খুলনায় মাছ রান্নাতেও চুইঝাল অনেকে ব্যবহার করে।
কোন এলাকায় বা পরিবেশে উৎপাদিত হয়?
খুলনা এবং সাতক্ষীরা আর বাগেরহাট জেলার কিছু অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির চুইঝাল হয়। চাষিদের মতে, বেলে দোঁআশ মাটিতে ভালো হয় চুই। মাটিগুণেই এইসব এলাকায় ভালো চুই হয়। দেশের অন্য এলাকায় এখন কিছু চাষ হলেও তা এখানকার মতো হয় না। চুই গাছ বাঁচানো বেশ কঠিন। বেশি শীত, বেশি গরম আবার বেশি বর্ষা হলে গাছ মারা যায়।
বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা, রংপুরেও এটা হয় এবং দেশের অন্য এলাকায় এখন কিছু চাষ হলেও তা খুলনার মতো হয় না। খুলনার চুইটা খেতে বেশি মজা এইজন্য খুলনার চুই ঝাল টার দামও বেশি আর কাষ্টমারের কাছে চাহিদা বেশি।
দামঃ
কোয়ালিটি অনুযায়ী সাধারণত (১৫০-১৫০০) টাকা এই রেঞ্জের মধ্যে দাম ওঠা নামা করে। কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে দাম।
চুইঝালের উপকারিতা
চুইঝালের অনেক গুণ আছে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য। ব্যাথা নিরসনে বিশেষ করে আর্থাইটিস জনিত ব্যাথায় এটা খুব কার্যকরী। যে কারণে এটার চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। টনসিল ও লিভারের জন্য চুইয়ের রস ভালো টনিক। সর্দি, কাশি ও মুখে রুচি আনার জন্য চুইঝাল ঝাঁঝটা খুব কাজে দেয়।
খুলনায় চুইঝাল দিয়ে প্রসিদ্ধ কিছু খাবার
১. চুকনগরের আব্বাস হোটেলের চুইঝাল দিয়ে খাসির মাংস। প্রায় ২০ বছর যাবত এটা খুব প্রিয় খুলনা অঞ্চলের মানুষের কাছে। বন্ধুবান্ধব দলধরে ও পরিবার নিয়ে খুলনা শহর হেকে ২০/২৫ কিলোমিটার দূরে এই মাংস থেকে অনেকেই যান।
২. খুলনার জিরো পয়েন্টে প্রায় ১ যুগ ধরে কিছু দোকান গড়ে উঠেছে যেখানে গরুর মাংস এই চুইঝাল দিয়ে মসলাদার করে রান্না করা হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা খুব উৎসবের আমেজে এইখানে খায়। দামেও সুলভ।
৩. চুইঝাল দিয়ে মুড়ি মাখা- এটা খুলনার বি. এল. কলেজে পাওয়া যায়। বিশেষভাবে তৈরি এই মুড়িমাখা অসাধারণ।
চুই ঝাল কেনো খাবো
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা এলাকায় জনপ্রিয় একটি ঝাল হলো চুইঝাল। বর্তমানে দেশের অন্যান্য জেলাতেও ঝাল হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
চুই ঝালের উপকারিতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা দিতেই আমার এই লেখা। চুই লতা জাতীয় গাছ। এর কাণ্ড ধূসর এবং পাতা পান পাতার মতো, দেখতে সবুজ রংয়ের। চুইঝাল খেতে ঝাল হলেও এর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ।
চুইলতার শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুল- ফল সবই ভেষজ গুণসম্পন্ন। এছাড়াও মসলা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। তবে ঝাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হাঁসের মাংস ও গরুর মাংস রান্না করতে।
মূলত,রান্নার জন্যে চুইঝালের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে। এছাড়াও এতে রয়েছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস,মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল থাকে।
চুই এর শিকড়ে রয়েছে ১৩.১৫ শতাংশ পিপারিন।
আসুন এবার জেনে নিই চুইঝালের উপকারিতা।
১. সমূহরুচি বাড়াতে
সমূহরুচি বাড়াতে খাবারের রুচি বাড়াতে ও ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
২. ক্যানসার প্রতিরোধে
এতে প্রচুর পরিমাণে আইসোফ্লাভোন ও অ্যালকালয়েড নামক ফাইটোক্যামিকাল রয়েছে যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৩. হৃদরোগ প্রতিরোধে
দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এটি হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
৪. পাকস্থলীর সমস্যা দূরীকরণে
পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ দূর করে। তাছাড়া গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৫. মানসিক প্রশান্তিতে
স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে।
৬. ব্যথা দূর করতে
আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা দূর করে শরীর সতেজ রাখতে সহায়তা করে।
৭. ঘুমের ওষুধ হিসেবে
এটি ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করে এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
৮. প্রসূতি ব্যথা
প্রসূতি মায়ের প্রসব-পরবর্তী ব্যথা প্রশমনে ভালো কাজ করে চুইঝাল। সদ্যপ্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা কমাতে চুইঝাল ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
অ্যাজমা ও ব্রংকাইটিস রোগের ওষুধ হিসেবে
অ্যাজমা ও ব্রংকাইটিস রোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে।ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগপ্রতিরোধে চুইঝাল বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগপ্রতিরোধে সাহায্য করে।
সুতরাং, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মরিচের বিকল্প হিসেবে চুইঝালের জনপ্রিয়তা বাড়লে দেশের হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে ভেষজ গুণ থাকার কারণে অনেক রোগব্যাধির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
চুইঝালে গরুর মাংসের রেসিপি
খুলনাঞ্চলের মানুষ চুইঝাল ছাড়া মাংস রান্নার কথা ভাবতেই পারে না। কারণ চুইঝালের সুঘ্রাণ মাংসকে করে তোলে অতুলনীয় সুস্বাদু।
আজ আপনাদের জন্য সেই চুইঝালে গরুর মাংসের রেসিপি।
উপকরণ:
গরুর মাংস ১ কেজি, চুইঝাল(Chui Jhal – চুই ঝাল) মাঝারি টুকরা করে কাটা ২ কাপ, আলু স্লাইস ১কাপ, আদাবাটা ২ টেবিল-চামচ, রসুনবাটা ১ টেবিল-চামচ, মরিচগুঁড়া ১ টেবিল-চামচ, হলুদগুঁড়া ১ চা-চামচ, জিরাবাটা ১ চা-চামচ, পেঁয়াজকুচি ১ কাপ, লবণ স্বাদমতো, টকদই আধা কাপ, তেজপাতা ৪টি, দারচিনি ৪ টুকরা, এলাচ ৪টি, লবঙ্গ ৬টি, কাঁচা মরিচ ৫-৬টি, সরিষার তেল ১ কাপ, গরম মসলার গুঁড়া ১ চা-চামচ, জিরা ভাজা গুঁড়া আধা চা-চামচ, লেবুর রস-১ টেবিল চামচ, ধনে পাতা।
প্রণালী: মাংস ধুয়ে লবণ ও টকদই দিয়ে মেখে ১ঘণ্টা রাখুন। তেল গরম করে পেঁয়াজ ভেজে তাতে সব মসলা কষিয়ে মাংস, চুইঝাল ও আলু দিয়ে কয়েকবার কষান।
পরে পানি দিন। মাংসের ঝোল শুকিয়ে তেলের ওপর এলে গরম মসলার গুঁড়া, জিরা ভাজা গুঁড়া দিয়ে নামিয়ে নিন। গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
(সংগৃহিত)
Post a Comment