GuidePedia

2
ট্রান্স ফ্যাটঃ একটি নীরব ঘাতক

আমরা রান্নার কাজে যে সকল তেল ব্যবহার করি তাতে বিদ্যমান কার্বন-কার্বন ডাবল বন্ডের উপর ভিত্তি করে তেলকে বড় দুই ভাগে ভাগ করা যায়। আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যেগুলো আমাদের ঘরে অর্থাৎ কক্ষ তাপমাত্রায় তরল হিসেবে থাকে। এই তেলের মধ্যে কার্বন কার্বন ডাবল বন্ড বিদ্যমান। আর কক্ষ তাপমাত্রায় যেগুলো তরল না, সেগুলোতে ডাবল বন্ডেজ থাকেনা, এবং এদেরকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বলা হয়। এনিমেল সোর্স থেকে প্রাপ্ত বেশিরভাগ ফ্যাট হচ্ছে স্যাচুরেটেড, অন্যদিকে মাছ ও ভেজিটেবল সোর্স হতে প্রাপ্ত ফ্যাট সাধারণত আনস্যচুরেটেড হয়ে থাকে। এটা মোটামুটি সিদ্ধ যে, কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণে হার্টের রোগ ও অন্যান্য রোগ কম হয়।
*এখানে মনে রাখতে হবে, ডাবল বন্ড গুলোই বিক্রিয়া ঘটানোর জন্যে উপর্যুক্ত।

ট্রান্স ফ্যাট কি?

অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে সিস-ট্রান্স খুবই পরিচিত টার্ম। সহজ করে বললে, ডাবল বন্ডের মধ্যে একটা মোচড় খেয়ে ট্রান্স হয়ে যাওয়া। উদাহরণ দিয়ে বুঝালে, মানুষের দেহের গলাটাকে একটা ডাবল বন্ড তুলনা করা যেতে পারে। সাধারণ অবস্থায় আমার সবাই সিস গঠনে; কিন্তু কারো যদি ঘাড় মোচড়িয়ে দেহ সামনে আর চেহারা পারমানেন্টলি পিছনে করে দেয়া যায়, তবে সেটা হবে ট্রান্স গঠন। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বেশিরভাগ তেলই হচ্ছে সিস গঠনের।

ট্রান্স ফ্যাট কোথায় পাওয়া যায়?

সাধারণত গরু ছাগলের পাকস্থলীতে ট্রান্স ফ্যাট (vaccenic acid) ন্যাচারালি তৈরি হয়, যা তাদের শরীরের সমস্ত ফ্যাটের ৪-১১ শতাংশ। এই ট্রান্স ফ্যাট মাংস, দুধ, বাটার ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। ফ্রুটস এ ফর এক্সাম্পল, বেদানাতে ফ্যাটের পরিমাণ খুবই সামান্য, তবে এতে বিদ্যমান ফ্যাটের ৭০% হচ্ছে ট্রান্স ফ্যাট (punicic acid)।

এছাড়া রান্নার সময় তাপে সিস গঠন ট্রান্স গঠনে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। তাই একই তেল বারবার ব্যবহার পরিহার্য। আমাদের নিত্য দিনের খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের একটি বড় উৎস হচ্ছে ডালডা অর্থাৎ হাইড্রোজেনেটেড ভেজিটেবল ওয়েল। অনেকের কাছে ডালডা, বনস্পতি ঘি নামে পরিচিত।

কিভাবে প্রস্তুত করা হয় এই ডালডা?

আমরা সাধারণত রান্নার কাজে যে সকল তেল ব্যবহার করি সেগুলো কক্ষ তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। যেমন সয়াবিন তেল, কর্ন তেল, সুর্যমুখী তেল, ধানের তুষের তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। মেটাল ক্যাটালিস্ট যেমন, নিকেল ক্যাটালিস্ট এর উপস্থিতিতে প্রায় ১০ বার চাপে, এসব তেলের মধ্যে দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস চালনা করা হলে তরল তেলে বিদ্যমান ডাবল বন্ধন গুলি ভেঙ্গে যায় ও সেখানে কার্বন-হাইড্রোজেন সিঙ্গেল বন্ধন তৈরি হয়। তখন আর তেল তরল থাকেনা, সলিড হয়ে যায়, এটাই হচ্ছে ডালডা। উল্লেখ্য ডালডা প্রস্তুত করার সময় সিস গঠন থেকে প্রচুর পরিমাণ ট্রান্স গঠন তৈরি হয়।

কেন ডালডা ব্যবহার করা হয়?

আগেই বলেছিলাম তরল তেলে বিদ্যমান ডাবল বন্ড গুলো বিক্রিয়া ঘটাতে পারে। তাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রসেসিং এ তরল তেল ব্যবহার করা হলে সেখানে বিদ্যমান ডাবল বন্ড অক্সিজেন দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে। এটাকে বলে ফ্যাট অক্সিডেশন এবং এর ফলে (rancid flavour) বাজে গন্ধ হয়ে থাকে।
একারণে ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি গুলো ডাবল বন্ডেজ মুক্ত ফ্যাট, হাইড্রোজেনেটেড ভেজিটেবল ওয়েল, ডালডা ব্যবহার করে। এতে করে প্রোডাক্ট এর শেল্ফলাইফ বেড়ে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে খাবার কড়কড়া থাকে, বাজে গন্ধ হয়না।

ডালডার সবচাইতে বেশি ব্যবহার হয় বেকারি পণ্যে। এছাড়াও চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, চিপস ভাজা ইত্যাদিতে ডালডার ব্যবহার হয়ে থাকে। উপরন্তু, আমাদের দেশে পরোটা ভাজতে, লাচ্ছা সেমাই ভাজতে ডালডার ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে।

ট্রান্স ফ্যাটে শরীরের কি ক্ষতি?

ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ সেরাম লিপিড লেভেল, ইনফ্লামেশন, ও এন্ডোথেলিয়াল সেল ফাংশন এর মাধ্যমে কার্ডিওভাসকুলার (হার্টের) রোগ বাড়িয়ে দেয়। ট্রান্স ফ্যাটের কনসাম্পশন শরীরে LDL (bad) : HDL (good) কোলেস্টেরল এর অনুপাত বাড়িয়ে দেয়, অর্থাৎ শরীরে ভাল কোলেস্টেরল কমে যায়, ও খারাপ কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রতিদিন ৫ গ্রামের অধিক ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ কার্ডিওভাসকুলার রোগের সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। 

ট্রান্স ফ্যাট নিয়ে বিশ্বের কোন দেশ কি করছে?

ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতি অনুধাবন করে পুরো পৃথিবীর মধ্যে ডেনমার্ক সর্বপ্রথম ২০০৩ সালে খাদ্য থেকে ট্রান্স ফ্যাট মুক্ত করতে আইন জারী করে। তারা লিমিট নির্ধারন করে দেয় যে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারে বা অন্য যে কোন তেল বা চর্বিতে ২ গ্রামের অধিক ট্রান্স ফ্যাট থাকতে পারবে না।

এই আঈনের ফলে ২০০৩ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে হার্টের রোগে মৃত্যু সংখ্যা প্রতি ১০০,০০০ এ ৩৫৯ থেকে ২১০ এ নেমে এসেছে। মূলত ২০০৪ – ২০০৬ সালের মধ্যেই ফলাফল দৃশ্যমান হতে থাকে। ডেনমার্কের এই সুফল দেখে ২০০৬ সালে নিউ ইয়র্ক সিটি ট্রান্স ফ্যাট ব্যান করে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আঈন, ইইউ এর আবার নিজস্ব বিধান রয়েছে। ইউকে, কানাডা সবাই এটা নিয়ে কাজ করেছে। ২০০৯-২০১১ এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, আইসল্যান্ড, ও সুইজারল্যান্ড ডেনিশ দের ফলো করে আঈন তৈরি করেছে। ২০১৩ সালে এসে ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন FDA ট্রান্স ফ্যাট কে আর সেইফ ফুড হিসেবে বিবেচনা করছে না বলে ঘোষণ দিয়েছে। FDA ২০১৮ সালে সকল কোম্পানি কে এক বছরের সময় বেধে দিয়েছে অল্টারনেটিভ খুজে বের করার জন্যে, ট্রান্স ফ্যাট সহযোগে নতুন খাদ্য আর প্রস্তুত করতে পারবে না।

এদিকে, ইন্ডিয়ার খাদ্য রেগুলেটরি অধিদপ্তর ২০২২ সালের মধ্যে ইন্ডিয়াকে ট্রান্স ফ্যাট মুক্ত করতে ঘোষণা দিয়েছে। এজন্যে সকল তেল চর্বিতে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা ডেনমার্কের নির্ধারিত মাত্রায় অর্থাৎ ২% বা এর নিচে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে।

**আশা করি লেখাটি বোধগম্য হয়েছে এবং জনসাধারণ সচেতন হবে ও ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ কমাতে পারবে।

ড. মোঃ নাহিদুল ইসলাম
Dr. Md Nahidul Islam
খাদ্য গবেষক
ওডেন্স, ডেনমার্ক
মে ২৫, ২০১৯

Post a Comment

  1. সিনগেল বন্ডের তেল মানে তো স্যাচুরেটেড ফ্যাট। মানে ট্রান্স ফ্যাট হচ্ছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট!
    মানে আপনার দেশে গরু, মুরগি, ডিম দুধ ছাড়াও সকল ভোজ্য তেলই নিষিদ্ধ? ২% এর বেশি সিনগেল বন্ড ফ্যাট সব গুলোতেই। ক্যানোলা ও সরিষা ৭%, বাকি সব তো আরো বেশি।

    ReplyDelete

 
Top