GuidePedia

0
সম্মানিত অধ্যক্ষ, ভূটান এবং বাংলাদেশের সকল প্রতিনিধি, কলেজের সকল স্টাফ এবং আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, শুভ সকাল।


একটা সমস্যা হয়ে গেল। দুটো কারণে আমি আজ বেশি কথা বলতে পারব না। প্রথম কারণ হলো, যদি বেশি কথা বলি তাহলে তোমরা বলবে আমি পলিটিশিয়ানের মত করে কথা বলছি।

আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আমার স্ত্রীর সামনে বেশি কথা যাবে না, কারণ সে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সে তার ব্যাগে সবসময় ১০ টা অ্যামিট্রিপটিলিন রেখে দেয়।

যাই হোক, আজকে এখানে আসতে পেরে আমি অনেক খুশি। এই শহরে আমার জীবনের প্রায় দশ বছর কেটেছে। আর সাথে আজকে তো আপনাদের পহেলা বৈশাখ।

আমি এই মেডিকেলে প্রথম আসি ১৯৯১ এর শেষে ২৫/২৬ নভেম্বরের দিকে। আমি আমার সেশনে প্রায় চার-পাঁচ মাস পর ভর্তি হয়েছিলাম। ওই চার-পাঁচ মাসের সিলেবাস গোছানোর জন্যে জন্য আমাকে পরে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি একটা স্ট্র্যাটেজি ফলো করতাম। যেমন ধরুন আগামীকাল আমাদের এনাটমির কোন একটা টপিক পড়ানো হবে, আমি সেটা আজকে রাতে একবার পড়ে রাখতাম। এরপর পরদিন যখন স্যার পড়ানো শেষ করতেন, আমি আমার বন্ধুদের ক্লাসের পরপরই নিয়ে যেতাম ডিসেকশন হলে। যা-ই পারতাম যেটুকু পারতাম, ওদের কাছে বারবার ডেমো দিতাম ভুল হোক আর যা হোক। তাতে আমার আরেকবার জিনিসটা পড়া হয়ে যেত। এভাবে আমার অন্য ব্যাচমেটদের কোন টপিক একবার পড়া হতে হতে আমার সেটা কয়েকবার পড়া হয়ে যেত। যেকোন জিনিস ভাল করে বুঝতে হলে পড়ার পাশাপাশি ডিসকাশনের উপর জোর দিতে হবে। জীবনে এর বিকল্প নেই।

তখন ১৯৯৬ সাল, দিন তারিখটা ঠিক সঠিক মনে নেই আমার আমি তখন ফোর্থ ইয়ারে। হঠাৎ আমার পেটে ব্যাথা শুরু হল আচমকা। প্রচন্ড ব্যাথায় কাতর,রাত নয়টার দিকে একবার বমিও করেছি। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। রাতে আরও বেশ কয়েকবার বমি হলো। পরদিন খুব ভোরে আমার এক বন্ধু আর বড় ভাই তানজিং দর্জি (ম-২৪) আমাকে নিয়ে যান আউটডোরে। ওখানকার চিকিৎসকের কাছে আমি আগে কখনো যাই নি। স্টুডেন্ট হিসাবে তো নই রোগী হিসাবেও না৷ উনি আমার কাছ থেকে জানলো আমার পেপটিক সমস্যার জন্য আমি অনেকদিন ধরে রেনিটিডিন ওমিপ্রাজল এগুলো খাই।  এটুকু শুনেই আমাকে আর হিস্টোরি না নিয়ে ওমিপ্রাজল সহ আরও কিছু ওষুধ লিখে দেন। আমি চলে আসলাম হলে। ওষুধ খেয়ে আমার কোন ইম্প্রুভমেন্ট হলোনা। ব্যাথা আগের মতই রয়ে গেল । বিকালে আবার গেলাম ঐ স্যারের কাছে। তিনি আমার অবস্থা দেখে স্টুডেন্ট কেবিনে ভর্তি হতে বললেন। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। পরের দিন মেডিসিনের বেশ কয়েকজন স্যাররা মিলে আমাকে রাউন্ডে দেখতে আসলো৷ তাদের পরামর্শ মত ট্রিটমেন্ট চললো। আমার কোন উন্নতি নেই এরও কয়েকদিন পর  অন্য একজন স্যার আসলেন দেখতে স্টুডেন্ট কেবিনে । আমার মনে হলে উনি সার্জারী ডিপার্টমেন্টের কেউ। কিছুক্ষণ আমাকে দেখে বললেন এটা তো এপেন্ডিসাইটিস এর কেস৷ এতদিন ধরে সে এভাবে রেখে দিয়েছে, এটা তো এখন বাস্ট এপেন্ডিক্সের দিকে এগুচ্ছে। আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন এটা খুবই সহজ অপারেশন। আমি তিনশো-চারশো এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করেছি। বাবা তোমার ভয় নেই। তোমার বাবা মা দূরদেশে থাকে। তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে আমাদের কাছে। তুমি পুরোপুরি নিরাপদ আমাদের হাতে। স্যারের এই কথাগুলো এখনও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। সেদিন রাত নয়টার দিকে আমি অপারেশন টেবিলে আমার অপারেশন হলো, এপেন্ডিক্স বের করা হলো। গ্যাংগ্রিনাস এপেন্ডিক্স। কিছুদিন পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। সেদিনের ঐ মানুষটি ছিলেন প্রফেসর খাদেমুল ইসলাম স্যার।




 তখন আমি ফোরথ ইয়ারের স্টুডেন্ট, এপেন্ডিসাইটিস সম্বন্ধে আমার ভালো ধারণ ছিল এবং আমি এটাও জানতাম এটা খুবই ছোট্ট অপারেশন, রেসিডেন্টরাই চাইলে করতে পারে। কিন্তু স্যার তারপরেও বারবার আমাকে সাহস দিচ্ছিলেন, পরিবারের থেকে দূরে একটা ছেলেকে মনোবল যোগাচ্ছিলেন। ওই অপারেশনটার পর থেকে স্যার আমার কাছে আমার ভগবানের মত হয়ে গেলেন।

আমাদের এই যে পেশাটা, খুব সহজেই আমরা মানুষ থেকে ভগবান হতে পারি। আমরা ডাক্তাররা সকাল থেকে সন্ধ্যা হাসপাতালে রোগী নিয়ে কাজ করতে করতে আমাদের কাছে রোগী দেখাটা অনেকটা রুটিনমত হয়ে যায়। এতে করে অনেক সময়ই মিসডায়াগনোসিস করে ফেলি আমরা। একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা রোগীদের সাথেই সারাটাদিন থাকলেও রোগীরা কিন্তু সবসময় আমাদের সাথে থাকেন না। তারা তাদের জীবনে একবার কি দুইবার আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন এবং ওই এক দুইবারের আমাদের প্রতি যে ধারণা জন্মে সেটাই আজীবন মনে রাখেন। তাই আমাদের উচিত প্রতিটি রোগীকেই আমাদের সর্বোচ্চটা দেয়া।

আমি অন্তর থেকে স্যারকে সবসময় স্মরন করি । আমি এমবিবিএস শেষ করার পর এফসিপিএস করি বাংলাদেশেই।পার্ট টু পরীক্ষার ফলাফল যখন হবে বিকালের দিকে আমরা সবাই বসে আছি নিচ তলায় রেজাল্টের অপেক্ষায়। হঠাৎ স্যার আসলেন,আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন," You have done it boy".

সেদিনকার পর ২০০২ সালে জুন মাসের দিকে আমি ফিরে যাই আমার নিজ দেশ ভুটানে। সেখানে একটা হাসপাতালে কাজ শুরু করি জেনারেল সার্জন হিসাবে।প্রথমদিনই আমি ছুটে গিয়েছিলাম মন্দিরে দোয়া নিতে। এর পরদিন, আমাদের হসপিটালে এপেন্ডিসাইটিসের একজন রোগী আসল। আমি আমার জুনিয়র কলিগকে বললাম তুমি এটা করে ফেল,খুবই সহজ কাজ। না পারলে তো আমি আছিই। প্রায় ১০ মিনিট পর ও আমাকে ডাকল। আমাকে যেতেই হবে। আমি যাওয়ার সময় অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসা একজন সুন্দরী মহিলা এসে আমার সাথে পরিচিত হয়ে বলতেছেন,আমি এই হাসপাতালেরই একজন নতুন ডাক্তার। কয়েকদিন আগেই কাজ শুরু করেছি। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। আমার স্যারের মত করেই। সেদিনের সেই মহিলাটিই হলেন আমার স্ত্রী। যিনি আজ আমার সাথে উপস্থিত । আর ঐ এপেন্ডিসাইটিসের রোগী ছিলেন ওর চাচা।  এভাবেই আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এপেন্ডিক্সকে আপনারা বলেন ভেস্টিজিয়াল অরগান, কোন কাজ নাই।  কিন্তু আমার জীবনে এর অনেক গুরুত্ব।  বুঝতেই পারছেন, কেন!

আমি পলিটিকস করা শুরু করি হেলথ সেক্টরের প্রতি আমার প্যাশন থেকে৷ ময়মনসিংহ মেডিকেলে আমার রুমমেট ছিল আমার বন্ধু তানজিং দর্জি। যিনি এখানে উপস্থিত আছেন, আমার রুমমেট, আমার বড় ভাই, ম-২৪ ব্যাচের । তিনি এখন বর্তমানে ফরেন মিনিস্টার। আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই তার সাথে ঘুরতাম। ক্যান্টিনে একসাথে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতাম। এমবিবিএস শেষে ভুটানে আমরা এক হসপিটালে কাজ শুরু করি। পরে ভোটে জয় লাভ করে আমরা সরকার গঠন করি।  এই যে এখন আমি আজ প্রাইম মিনিস্টার, উনি, আমার সিনিয়র বড়ভাই ই আমাকে প্রাইম মিনিস্টার বানিয়েছেন। উনি ফরেন মিনিস্টার হলে কি হবে, আমাদের পার্টির ফাউন্ডার কিন্তু উনিই। বাগমারার ওয়েস্ট বিল্ডিং এর ২০ নাম্বার রুমে থাকার সময়ে আমরা আমাদের দেশ নিয়ে আলোচনা করতাম। কী কী সমস্যা আছে হেলথ সেক্টরে কিভাবে সেগুলো সমাধান করা যায় আলাপ করতাম। তারপরে পড়াশুনা শেষ করে ভূটানে এলাম, তারপর পার্টি ফর্ম করার কথা তিনিই প্রথম বলেন। এই যে এত বছর ধরে আমরা একসাথে আছি কিন্তু এর ভিতরে একবারো আমাদের ভিতরে কখনো কোন আর্গুমেন্ট হয়নি। কখনো কোন ভুল বোঝাবুঝি তৈরী হয়নি। কারন আমরা একটা মিউচুয়াল স্ট্যান্ডার্ড ফলো করতাম। নিজেদের সেই অনুযায়ী তৈরী করেছি। সবসময় অপরজনের মতামত কে গুরুত্ব দিয়েছি। তার কাছে যা অফ হোয়াইট আমার কাছে তা সাদা, তো কি হয়েছে৷ আমরা দুইজনই সঠিক নিজের জায়গা থেকে। একজন কখনো মতামত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করিনি। দুটো মতামত কে পাশাপাশি রেখে চলেছি৷ এটাই আমাদের সফলতার মূলমন্ত্র। নিজেদের দেশের জন্য কিছু করার চিন্তাভাবনা আমাদের তখন থেকেই ছিল। আমরা যখন দল গঠন করি নির্বাচনের জন্য তখন আমাদের সমসাময়িক আরও চারটি দল ছিল। শেষপর্যন্ত আমরাই জয়লাভ করি। কারন আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে হেলথ সেক্টর নিয়ে পয়েন্টগুলো ছিল বেশ স্ট্রং৷ সাধারন মানুষ এই জন্যেই আমাদের পার্টিকে বেছে নিয়েছে। আমি কিংবা উনি পলিটিকস করি বলে কিন্তু ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দেইনি। আমরা অফ ডে তে এখনো হসপিটালে ডাক্তার হিসাবেই বসি। চেষ্টা করি নিজের সর্বোচ্চ টুকু দেয়ার।


আপনারা সবাই একদিন ডাক্তার হবেন। আপনারা একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন, You have to be a good human being first to be a good surgeon. I hope this hall is filled with good human beings. You will be a surgeon for sure someday. I have no doubt.But you have to be a good surgeon with a good heart.

Don't Be Ambitious, Do Your Best. Be A Good Human Being. আগে আপনি একজন ভালো মানুষ হন,আপনি এমনিতেই একজন ভালো ডাক্তার হয়ে যাবেন। আর ওই যে বলে না, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যেই করে- এটা সবাই মনে রাখবেন।


His Excellency Dr. Lotay Tshering
M-28
Honourable Prime Minister
Kingdom of Bhutan.

লেকার স্বত্বঃ হিউম্যান অফ এমএমসি 

Post a Comment

 
Top