GuidePedia

1
ডলার কেন ইন্টারন্যাশনাল কারেন্সি? সরকার কেন ইচ্ছেমত যতখুশি টাকা ছাপাতে পারে না?

সম্প্রতি রাশিয়ার ভস্টক আর তেহরান সম্মেলনে একটা বিষয় কমন ছিল, বানিজ্যে ডলারের ব্যবহার কমানো। এই দাবিতে দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে রাশিয়া চিন ইরান তুরস্ক সহ আরো কিছু দেশ ।

টাকার মান কমছে আর ডলারের দাম বাড়ছেই কারনটা কী ? ইউরোপের ভূলের কারনে ১৯৭১ সালে সমগ্র দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। পরিবর্তনটি করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট "রিচার্ড নিক্সন" এই অপকর্মটি করেন বলে এটাকে বলে ‘নিক্সন শক’। মানে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সারা বিশ্বকে একটা ইলেকট্রিক শক দেন সারা বিশ্বকে। আপনার সম্পদ কিভাবে টাকায় পরিণত হল তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? টাকা তো কিছু স্পেশালি প্রিন্ট করা কাগজ তাইনা? সরকার যদি ইচ্ছেমতন টাকা প্রিন্ট করে তাহলেই কি সম্পদের মূল পরিমাণ বেড়ে যায়? কখনো ভেবে দেখেছি আমরা? তাহলে তো দুনিয়ার সব সরকারই কোন কাজ কর্ম না করে শুধু টাকাই প্রিন্ট করতো, তাইনা?

প্রকৃতপক্ষে আপনি ইন্ডাষ্ট্রিতে যা উৎপাদন করেন এবং যেই ফসল-ফলাদি উৎপন্ন করেন সেটাই হল আপনার প্রকৃত সম্পদ। সেই প্রকৃত সম্পদের সমতুল্য টাকা প্রিন্ট করা হয়, এর বেশী প্রিন্ট করলে জিনিসের দাম বেড়ে ইনফ্লেইশন হবে, মোট সম্পদ কখনো বাড়বে না। তবে আস্তে আস্তে একটু একটু করে টাকা প্রিন্ট করে বাজারে ছেড়ে দিলে কিন্তু মানুষ ইনফ্লেইশনটা টের পায় না যদি ইনফ্লেইশন হয়ে থাকেও। এবং সম্পদ উৎপাদন যদি টাকার প্রিন্ট করার হার থেকে বেশী হয়, তাহলে কিন্তু ইনফ্লেইশন না হয়ে ডিফ্লেইশন হবে (মানে জিনিসপত্রের দাম কমবে)।

প্রথমে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র – এসব ধাতুর মুদ্রা। এসব ধাতু ব্যবহারের সুবিধা হল এসব ধাতুর নিজস্ব একটা বাজার মূল্য আছে, প্রিন্টেট টাকার মতন এটা ইচ্ছেমতন প্রিন্ট করা যায় না বরং খনি থেকে তুলে বাজারে ছাড়তে হয়। তবে এসব মুদ্রা বহন করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় একসময় ইউরোপিয়ান কান্ট্রিগুলো স্বর্ণমুদ্রাকে ব্যাংকে জমা রেখে স্বর্ণমুদ্রার ইক্যুইভ্যালেন্ট ‘প্রিন্ট করা টাকা’ বাজারে ছাড়তে লাগলো। নিয়ম করা হল যে যখন তখন ইচ্ছে করলে প্রিন্ট করা টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে স্বর্ণ ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া যাবে। তার মানে তখন পর্যন্ত ‘প্রিন্ট করা টাকা’ হল স্বর্ণের রিসিট। [তবে তারা একটু চালাকি করলো, যতটুকু স্বর্ণ জমা থেকে তার প্রায় দশ গুন টাকা বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করলো (এক্ষেত্রে রিজার্ভ রেশিয়ো হয় ১০%)। কারণ সব মানুষ কিন্তু একসাথে ব্যাংকে গিয়ে টাকাকে স্বর্ণে রুপান্তর করেনা।]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সব ইউরোপিয়ান নেশন গুলো তাদের স্বর্ণগুলো নির্দিষ্ট ডলার রেইটে (এক আউন্স = ৩৫ ডলার এই রে্টে ) আমেরিকায় জমা রাখলো, আর আমেরিকার সাথে চুক্তি করলো যে যখনই তাদের দরকার হবে আমেরিকাকে প্রিন্টেড কারেন্সি দিবে, বিনিময়ে আমেরিকা গোল্ড ফিরত দিবে। (ওরা হয়ত ভয় পাচ্ছিল, হিটলার ইউরোপ দখল করে ফেললে সব স্বর্ণ হিটলারের হস্তগত হবে।) এই ব্যবস্থার নাম ছিল ‘ব্রিটন উডস সিস্টেম’এটা ৪৪ টি ইউরোপীয় দেশের সাথে আমেরিকার একটা অর্থনৈতিক চুক্তি। সবাই আমেরিকান ডলার কমন কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করে, কারণ গোল্ড ভল্টে রাখা অনিরাপদ।


এখন আমেরিকা হল অতিচালাক। তারা দেখলো তারা ইচ্ছা করলে এই গোল্ড ব্যবস্থাটা উঠিয়ে দিয়ে সারা দুনিয়াকে ডলার খাওয়াতে পারে। তাই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭১ সালে ঘোষণা করলো তারা আর ব্রিটন উডস সিস্টেম মানবে না, তারা নির্দিষ্ট কোন ডলার রেটে স্বর্ণ বেচাকেনা করবে না। স্বর্ণের দাম হবে অনির্দিষ্ট। মানে মার্কেট অটোমেটিকালী স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করবে। সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ডলার হয়ে গেলে ভাসমান মুদ্রা, এর এখন থেকে গোল্ডের উপর কোন ডিপেন্ডেন্সি নাই। ডলার আজ থেকে স্বর্ণ হতে স্বাধীনতা পেল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতে শক খাওয়ার কি আছে আসলে? ডলার গোল্ড থেকে মুক্ত হলে বাংলাদেশে বসে আমার অসুবিধা কি? শুধু অসুবিধা না, ব্যাপক অসুবিধা। অ- আমেরিকান সবারই ব্যাপক অসুবিধা, আর আমেরিকান সবারই ব্যাপক সুবিধা। কারণ, সব দেশকে ফরেইন রিজার্ভ আগে রাখতে হতো গোল্ডে। এখন সবাই রাখে ডলারে। গোল্ড থাকে আমেরিকায়। আমাদের ভল্টে থাকে শুধুই ডলার, যাহা কাগজ ছাড়া কিছুই নহে। এখন মনে করেন বাংলাদেশে ফরেইন রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার। এই ২২ বিলিয়ন ডলারের প্রকৃত মূল্য মনে করেন ২২ টন গোল্ড (ধরে নেন আরকি)। এখন, আমেরিকা করেকি, নিজেদের যুদ্ধ পরিচালনা স্ংক্রান্ত ব্যয়, ইন্টারনাল ক্রাইসিস এগুলা সামাল দেয়ার জন্য কোন উপায়ন্তর না পেয়ে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ছাপায়, এরপর এই ডলার সারাদুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ডলার ছাপানোয়, ডলারের মান কমে যায়, ব্যাপক ইনফ্লেইশন হয়। ফলে মনে করেন, মাত্র দশ মাসের মধ্যে ২২ বিলিয়ন ডলারের মূল্য কমে মাত্র ১১ টন গোল্ড হয়ে যেতে পারে। মানে অন্য কথায়, যেকোন পণ্যের দাম ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে প্রায় দ্বিগুন হয়ে যাতে পারে। মানে আপনার জমাকৃত অর্থের মূল্য ডেঞ্জারাসলি কমে যেতে পারে। এবং তা কমছেও।

আমেরিকা ইচ্ছাকৃতভাবে ডলার প্রিন্ট করে নিজেদের ধার দেনা শোধ করছে, নিজেদের মার্কেট টেনে টুনে সেইভ করছে, এবং সাথে সাথে সারা দুনিয়াই আমেরিকার যুদ্ধ এবং অন্যান্য ব্যয়ভার ইনডিরেক্টলি বহন করছে। তার মানে আপনার চাকরি-ব্যবসাকৃত অর্জিত সম্পদ কে ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে কিছু লোক ডলার প্রিন্ট করার মাধ্যমে কমিয়ে দিচ্ছে। বা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। সারা দুনিয়ার কিছুই করার নেই, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। আসলে এইটাই দুনিয়ার সবচে’ বড় চৌর্যবৃত্তি। আপনার যে মাসের বেতনে পেট চলেনা, তার কারণ হল আমেরিকানদের ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে কিছু লোকের ডলার প্রিন্ট করা, বুঝা গেল? আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক (সব প্রাইভেট ব্যাংকারদের এসোসিয়েশণ) ডোনাল ট্রাম্পের অনুমতি ক্রমে ব্যাংকগুলোকে সেইভ করার জন্য যখনই এক ট্রিলিয়ন ডলার প্রিন্ট করার সিদ্ধান্ত নিল, তখনই বুঝবেন, আসলে ওরা আপনার পকেট (আসলে সারাদুনিয়ার সকল মানুষের পকেট থেকে) থেকে এই টাকা টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সমাধান হল, ইন্টারন্যাশল মুদ্রা হিসেবে আবারও গোল্ডকে (মানে গোল্ড, সিলভার এবং তামা) ব্যবহার করা। গোল্ড কারেন্সির ইচ্ছামতন প্রিন্ট করা যায় না। গোল্ডের ইকুইভ্যালেন্ট মানি ছাড়া যেতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক লেনদেন অবশ্যই গোল্ডের রেসপেক্টে হতে হবে, ডলার দিয়ে নয় ।

শুধু ডলার প্রিন্ট করে সারা দুনিয়ায় তা ছড়ানোর ব্যবস্থাটা আছে বলেই আমেরিকা এখনও টিকে আছে। না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন আমেরিকার ও পতন এদ্দিনে হয়ে যেতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্ভাগ্য, যে তাদের রুবল সারা দুনিয়ার কমন মুদ্রা না। ইরাকে আর আফগানিস্তানে তো কত ট্রিলিয়ন খরচ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই, সারা দুনিয়ায় আমেরিকার ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ, তাও কোন সমস্যা নেই, কারণ আমেরিকা শুধু ডলার প্রিন্ট করে, প্রিন্ট করে ঋণ শোধ করে, আর যেই ইনফ্লেইশনটা হয়, তা সারা দুনিয়া একসাথে বহন করে, তাই আমেরিকার গায়ে লাগেনা। এটা মনে রাখবেন, আপনি, আমি সবাই ইনডিরেক্টলি ইরাক, আফগানিস্তান, ইসরাইল সব জায়গায় যুদ্ধের খরচ আমেরিকাকে যুগিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমরা ডলার ব্যবহার করছি। যতদিন গোল্ড ফিরে না আসে, ততদিন এই ব্যবস্থাই চলবে।


সংগৃহীত

Post a Comment

  1. আমি সাহস ও গর্বের সাথে কাজ করতে চাই,,সত উপার্জন করা করতে চাই,,

    ReplyDelete

 
Top